মস্কোর এক গোপন রাশিয়ান ইউনিট ড্রোন যুদ্ধের চিত্রই পাল্টে দিয়েছে—যে জায়গায় ইউক্রেন আগে সুবিধায় ছিল, সেটাই এখন তাদের বড় দুর্বলতা। রাশিয়ান বাহিনীর এই গোপন ইউনিটের নাম ‘রুবিকন’, যা মাত্র এক বছরে রুশ সামরিক ড্রোন সক্ষমতাকে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
গত বছরের জুনে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রে বেলোসভের অধীনে দ্রুত সম্প্রসারিত হয় রুবিকন ইউনিট। অক্টোবর ২০২৪-এ প্রকাশিত সরকারি ভিডিওতে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের নতুন ড্রোন তৈরি ও পরীক্ষা করছেন রুবিকনের সদস্যরা।
রুবিকন—রাশিয়ার সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড আনম্যানড টেকনোলজিস—প্রমাণ করে যে যুদ্ধের মাঝেই রুশ সেনাবাহিনী কীভাবে পুরোনো কঠোর কৌশল ত্যাগ করে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে।
ইউক্রেনও একই সময়ে একটি পৃথক শাখা তৈরি করেছিল—আনম্যানড সিস্টেমস ফোর্সেস। কিন্তু রুবিকনের দ্রুত উত্থান সব সমীকরণ পাল্টাতে শুরু করেছে।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেন, রাশিয়া তাদের ড্রোন বাহিনীর জন্য একটি বিশেষ সামরিক কমান্ড গঠন করবে। গত সপ্তাহেই ওই কমান্ড পুরোপুরি চালু হয়েছে।
“মাত্র এক বছর আগেও আমাদের সৈন্যদের কাছে এত ধরনের ড্রোন ছিল না। এখন সব পর্যায়ে নতুন কমান্ড গঠন করা হয়েছে এবং ইউনিটে অপারেটর, প্রকৌশলী, টেকনিক্যাল স্টাফ যোগ করা হচ্ছে।”
এমনকি ইউনিটের নিজস্ব প্রতীকও তৈরি করা হয়েছে—তীর-তরবারি, মাইক্রোচিপ, ডানা—সব মিলিয়ে ভবিষ্যত যুদ্ধ প্রযুক্তির প্রতীক।
রুবিকনের সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন—ফাইবার-অপটিক কেবলযুক্ত ড্রোন।
এগুলোর ভিডিও ফিড জ্যাম করা যায় না এবং রিয়েল টাইমে নিয়ন্ত্রণ থাকে। এই প্রযুক্তি যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারণ সুবিধা দিয়েছে রাশিয়াকে।
“রুবিকন শুধু রুশ ড্রোন ইউনিট নয়, তারা অন্য ইউনিটকেও প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী করছে।”
রুবিকন প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই সামনের সারিতে দেখা দেয় তাদের নতুন প্রজন্মের ড্রোন।
গত গ্রীষ্মে ইউক্রেনীয় বাহিনী যখন রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলে ঢোকে, রুবিকন সেখানে বড় ভূমিকা নেয়। কয়েকদিনের মধ্যেই ইউক্রেন জানায়—রাশিয়ার ড্রোন হামলায় তাদের সরবরাহ লাইন প্রায় পুরোপুরি কেটে গেছে।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে ২০২৪ সালের শুরুতে ইউক্রেনীয় বাহিনী এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়।
পরবর্তীতে দুই ইউক্রেনীয় কমান্ডার জানান—হঠাৎই যুদ্ধের ধরন বদলে যায়, তাদের রসদ, ড্রোন অপারেটর ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর ভয়ংকর আক্রমণ শুরু হয়। তখনো তারা জানত না এটি রুবিকনের কাজ।
বর্তমানে দোনেৎস্ক, কোস্টিয়ানটিনিভকা সহ বহু ফ্রন্টলাইনে রুবিকন ইউনিট সক্রিয়।
তারা রুশ বাহিনীর পিছনে থেকে ইউক্রেনের রসদ, যানবাহন, অ্যান্টেনা ও ড্রোন লঞ্চপয়েন্ট ধ্বংস করছে।
এক সপ্তাহে ইউক্রেনের একটি ব্রিগেড তাদের বেশিরভাগ যানবাহন ও যোগাযোগ সরঞ্জাম হারিয়েছে।
“এখন পুরো সংঘাতটাই ড্রোন-কেন্দ্রিক। রাশিয়া এই ক্ষেত্রে ইউক্রেনকে ছাড়িয়ে গেছে।”
রুবিকন শুধু আক্রমণ করে না—ইউক্রেনীয় ড্রোন ধ্বংস করতেও অত্যন্ত সফল।
ইউক্রেনীয় ইলেকট্রনিক যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ সের্হি বেসক্রেস্তনভ জানান,
“রুশ বাহিনী আমাদের ড্রোন দখল করে তাদের ভেতরের প্রতিটি ইলেকট্রনিক সিস্টেম পরীক্ষা করছে।”
রুবিকন ইতিমধ্যে দানিউব মোহনায় একটি ইউক্রেনীয় জাহাজ এবং কৃষ্ণ সাগরে আরেকটি গ্যাস প্ল্যাটফর্মে আঘাত করেছে।
ইউক্রেনও থেমে নেই। তারা রুবিকনের অবস্থান শনাক্ত করে সুমিতে কয়েকটি হামলা চালিয়েছে।
নতুন FP-2 ড্রোন তৈরি করেছে, যা ২০ কিলোমিটার দূর থেকে রুবিকনের কমান্ড সেন্টার লক্ষ্য করতে পারে।
কিন্তু ভিয়াচেস্লাভ নামে এক ইউক্রেনীয় কমান্ডার বলেন,
“রাশিয়ার কাছে যে সংখ্যায় ফাইবার-অপটিক ড্রোন আছে, সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা।”
“ড্রোন যুদ্ধ এমন গতিতে বদলাচ্ছে যে প্রতিটি সপ্তাহেই নতুন প্রযুক্তি আসছে। যুদ্ধ যেমন সেনাবাহিনীকে তৈরি করে, তেমনি সেনাবাহিনীও যুদ্ধকে বদলে দেয়।”
সুমির জঙ্গলে ইউক্রেনীয় কমান্ডারদের জীবন এখন এক রুটিনে আটকে গেছে—
“সনাক্ত করো, ধ্বংস করো… আবার সনাক্ত করো, আবার ধ্বংস করো।”
