নেচে-গেয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করছিলেন সাধারণ মানুষ। আর তাদের দিকে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছিল কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট এবং আসল গুলি। তানজানিয়ায় সরকার এখন প্রতিবাদের জবাব দিচ্ছে দমন-পীড়নে। অভিযোগ উঠেছে—সরকার-সমর্থিত সশস্ত্র ব্যক্তিদের দিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, গুম, হত্যা ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সরকারি ভাষ্য সবসময় একই—বহিরাগতরা নাকি দেশকে অস্থিতিশীল করছে।

পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায় এখন সাধারণ মানুষই সরকারের চোখে ‘বহিরাগত’। সরকারবিরোধী যে কোনো অবস্থানকে দেখা হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে।

গণতন্ত্রের দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সাধারণত শান্তি ফেরায়। কিন্তু সেরেঙ্গাতি আর কিলিমানজারোর দেশ তানজানিয়ায় ঘটেছে ঠিক তার উল্টোটা। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রকাশ্যে দেখা গেল ক্ষমতাসীন সিসিএম দলের একচ্ছত্র দাপট। বিরোধী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতাসহ নানা অভিযোগ এনে একের পর এক জেলে ভরা হয়েছে।

শুধু গ্রেপ্তারই নয়—সরকারবিরোধী অনেককে গুম করা হয়েছে, অনেককে হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দাবি—গত এক মাসে এক হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সরকার অবশ্য বলছে, এই সংখ্যা অতিরঞ্জিত।

গত ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা—রাষ্ট্রপতি সামিয়া সুলুহু হাসান পেয়েছেন ৯৭.৬৬% ভোট। ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শপথও নেন।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে, ফ্রান্স ২৪-এর বরাতে জানা যায়—তানজানিয়ার নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। জনগণের আস্থা নেই এই সংস্থার ওপর। নিরাপত্তা বাহিনীও নির্দ্বিধায় সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।

বিরোধীদের অভিযোগ—সামিয়ার কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না, তবুও বিরোধী প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করে জেলে ভরা হয়েছে। কেউ কেউ গুম হয়েছেন, কেউ হয়েছেন গুপ্তহত্যার শিকার।

ছাদেমা-সহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচনকে বলেছে ‘গণতন্ত্রের তামাশা’। তাদের দাবি—নির্বাচনের পর পাঁচদিন ইন্টারনেট বন্ধ রেখে বিরোধীদের ওপর ভয়াবহ হামলা চালানো হয়েছে।

বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। তানজানিয়ার বিভিন্ন শহরে গাড়ি, দোকানপাট, সরকারি ভবন জ্বলছে। রাস্তা-ঘাটে পড়ে আছে মৃতদেহ। আহতরা হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছেন দমন-পীড়নের আশঙ্কায়।
“রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ পায়ে গুলি এসে বিঁধল। পুলিশ লক্ষ্য করেই গুলি করছিল।”

সরকার বলছে—এসব নাশকতাকারীদের কাজ, প্রশাসন চেষ্টা করছে ‘বিশৃঙ্খলাকারীদের’ দমন করতে।

১৮ নভেম্বর বিবিসির প্রতিবেদনে রাষ্ট্রপতি সামিয়া বলেন—নির্বাচন-পরবর্তী সংঘাত দেশের ভাবমূর্তি ‘কলঙ্কিত’ করেছে। তার ভাষায়—
“আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ঋণ নিয়ে চলি। এই পরিস্থিতি আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।”

দেশজুড়ে বিক্ষোভের পর কমপক্ষে ২৪০ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছে। প্রায় ছয় দশকের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবার দারুণভাবে কেঁপে উঠেছে।

এদিকে সামিয়ার নতুন মন্ত্রিসভায় এসেছে নতুন চমক—তার মেয়ে বানু হাফিদ আমির হয়েছেন উপ-শিক্ষামন্ত্রী। তার স্বামীও নতুন মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন।

২১ নভেম্বর সিএনএন প্রকাশ করেছে মর্গের ভেতর মরদেহের স্তূপের ছবি। ভিক্টোরিয়া লেকের পাশেও পাওয়া গেছে গণকবরের চিহ্ন। সিএনএনের ভাষ্য—পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচআর জানিয়েছে—শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন, প্রকৃত সংখ্যা অজানা। নিহতদের লাশ রাখার জায়গা নেই হাসপাতালগুলোতে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আফ্রিকা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বলেছে—নির্বাচন ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে ‘জাতীয় বিপর্যয়’।

তানজানিয়ার মানুষ আর লোক দেখানো গণতন্ত্র চায় না। চায় প্রকৃত গণতন্ত্র—যেখানে ভয় নয়, কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে; যেখানে জনগণের ভোটে নেতা নির্বাচিত হবে।

কিন্তু এখন তাদের টাকায় কেনা গুলিতে প্রাণ দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর এই প্রতিবাদের আগুনে জ্বলছে তাদেরই প্রিয় দেশ—তানজানিয়া।

news