এই বছরই জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জন সহজ নয়, কারণ বছরের পর বছর ধরে জার্মানির সামরিক বাহিনী অবহেলাই পড়ে ছিল।

এখন, এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বড় একটি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে জার্মান জোট সরকার একটি নতুন বিলে সম্মত হয়েছে। রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান হুমকি এবং আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের মুখে তাদের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতেই এই উদ্যোগ।

এই ব্যাপক সংস্কার পরিকল্পনা অনুযায়ী, জার্মানি ২০৩৫ সালের মধ্যে তাদের সেনাসদস্যের সংখ্যা বাড়াবে। বর্তমানে যা ১ লাখ ৮০ হাজার, তা বাড়িয়ে করা হবে ২ লাখ ৬০ হাজারে। এছাড়াও থাকবে আরও ২ লাখ রিজার্ভ সৈন্য।

প্রথমদিকে, এই অভিযান চলবে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের উপর জোর দিয়ে। যারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাইবেন, তাদের জন্য থাকবে আকর্ষণীয় প্রণোদনা। মাসিক প্রাথমিক বেতন বাড়ানো হবে ৪৫০ ইউরো, যা দাঁড়াবে মাসে ২ হাজার ৬শ ইউরো বা প্রায় ৩ হাজার ডলার।

তবে, যদি শুধু স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগে কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সৈন্য না মেলে, তাহলে সরকারের হাতে থাকবে বাধ্যতামূলকভাবে তালিকাভুক্তির বিকল্প।

পরের বছর থেকেই, দেশের সব ১৮ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীকে একটি প্রশ্নপত্র দেওয়া হবে, যেখানে তাদের সামরিক চাকরিতে আগ্রহের বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নপত্র পুরণ করা বাধ্যতামূলক হবে। ২০২৭ সাল থেকে ১৮ বছর বয়সী সকল পুরুষের জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে মেডিকেল পরীক্ষা।

এই পদক্ষেপ নেওয়ার পেছনে বড় কারণ ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান যুদ্ধ। পাশাপাশি, ট্রাম্প প্রশাসনের সেই সতর্কতা যে ইউরোপকে নিজের নিরাপত্তা নিজেই নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা ইঙ্গিত করছেন, রাশিয়া ভবিষ্যতে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর ওপর হামলা চালাতেও পারে।

লন্ডনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউসের এক বিশেষজ্ঞ মিন্না অলান্ডার মনে করেন, জার্মানির ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ইউরোপের প্রতিরক্ষায় তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, "লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে সেটা ইউরোপের জন্য খুবই ভালো খবর হবে, তবে সেটা সম্ভবত ২০৩০-এর দশকের আগে হবে না।"

কিন্তু এত দেরি হলে কি সময়মতো প্রস্তুত হওয়া যাবে? জার্মানির প্রতিরক্ষা প্রধান জেনারেল কার্স্টেন ব্রুয়ার গত জুনেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, রাশিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণের জন্য ন্যাটোকে ২০২৯ সালের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যেতে হবে।

এই নতুন বিল নিয়ে জোট সরকারের ভেতরেও বেশ বিতর্ক হয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস 'লটারির মাধ্যমে নিয়োগ' এর মতো ধারণাগুলো বাতিল করেছেন। তার মতে, তরুণদের আকৃষ্ট করতে হবে ভালো বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা দিয়ে।

জার্মানিতে এক সময় ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সী পুরুষদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক служба ছিল, যা ২০১১ সালে বাতিল করে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবী সেনাবাহিনী গঠন করা হয়।

এই নতুন চুক্তিটি এখনও জার্মান সংসদে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। ধারণা করা হচ্ছে, বছরের শেষের দিকে এ নিয়ে ভোট হবে। অনুমোদন পেলে, ২০২৬ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হবে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিস্টোরিয়াস এই সংস্কারকে স্বাগত জানিয়ে সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, "কোনো উদ্বেগ বা ভয়ের কারণ নেই। কারণ শিক্ষাটা খুবই স্পষ্ট: আমাদের সেনাবাহিনী যত শক্তিশালী ও প্রতিরোধক্ষম হবে, কোনো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ততই কমবে।"

পিস্টোরিয়াস আরও বলেন, জার্মানির এই নতুন সামরিক মডেল ইউরোপের অন্যান্য দেশের জন্য উদাহরণ হতে পারে। তিনি বলেন, "আমরা যা করছি, সবার নজর সেদিকেই। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশের সাথেও আমরা কথা বলছি। আমাদের এই নিয়োগ মডেলটি বেশ আধুনিক, এটি অন্য দেশের জন্যও পথ দেখাতে পারে।"

কিন্তু এই পরিবর্তন নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। জার্মানির বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের সমর্থকরা যেকোনো ধরনের বাধ্যতামূলক নিয়োগের বিরোধী। একটি জরিপে দেখা গেছে, বামপন্থী দল ডাই লিঙ্কের ৮০% ভোটার এই ধারণার বিরুদ্ধে।

তবে বিশেষজ্ঞ অলান্ডারের মতে, শুধু স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দিয়েও জার্মানির মতো বড় দেশের জন্য লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব নয়। কিন্তু তিনি সতর্ক করেছেন, "আমার ভয় হলো, যদি জনগণের অনীহা সত্ত্বেও বাধ্যতামূলক служба চালু করা হয়, তাহলে অনেক তরুণ চরম ডানপন্থী বা বামপন্থী ideologies-এর দিকে ঝুঁকতে পারে।"

জার্মান তরুণদের মধ্যেও বাধ্যতামূলক সামরিক নিয়ে অনীহা স্পষ্ট। ১৭ বছর বয়সী এক তরুণী সিএনএন-কে বলে, "নিজেদের রক্ষা করতে পারাটা জরুরি, কিন্তু সেজন্যই তো আমরা ন্যাটো জোটে আছি। আমি জার্মানিকে ভালোবাসলেও বলব না যে এখন এই দেশের জন্য লড়াই করতে চাই। যুদ্ধ ছাড়াও আমার জীবনের পরিকল্পনা আছে।"

অন্যদিকে, ২১ বছর বয়সী লিওনিদ বেকজারভ সেনাবাহিনীতে বিনিয়োগ সমর্থন করলেও বাধ্যতামূলক নিয়োগ নিয়ে সন্দিহান। তার মতে, "সেনাবাহিনী শক্তিশালী করা ভালো, কিন্তু সবার জন্য বাধ্যতামূলক করে তোলাটা ভুল।"

অন্যান্য অনেক তরুণের মতো তারাও উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে সামরিক চাকরিতে ডাক পড়লে তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হবে।

সরকারি পরিসংখ্যানেও এই অনীহার প্রমাণ মেলে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে, বিশেষ করে যখন বাধ্যতামূলক নিয়োগের আলোচনা জোরেশোরে উঠেছে, তখন বিবেকবান আপত্তিকারীর মর্যাদার জন্য আবেদনের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ২০১১ সালের পর এবারই এই সংখ্যা সর্বোচ্চ।

শীতল যুদ্ধের পর থেকেই জার্মান সেনাবাহিনী বা বুন্দেসওয়েহর তহবিল সংকটে ভুগেছে। দীর্ঘদিন ধরে জার্মানির সামরিক ব্যয় ন্যাটোর লক্ষ্যমাত্রা ২% এরও নিচে ছিল।

কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে, তখনই সব বদলে যায়। জার্মানি তখন 'পরিবর্তনের সময়' ঘোষণা করে এবং সেনাবাহিনী আধুনিকীকরণে ১০০ বিলিয়ন ইউরোর বিশেষ তহবিল গঠন করে।

এই মনোভাবের পরিবর্তন আরও স্পষ্ট হয় যখন এই বছর চ্যান্সেলর মের্জ শুধু ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ারই প্রতিশ্রুতি দেননি,同时 ন্যাটোর লক্ষ্য পূরণে সামরিক ব্যয় দ্বিগুণ করারও অঙ্গীকার করেছেন। মের্জ স্পষ্টই বলেছেন, "(রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির) পুতিন কেবল শক্তির ভাষাই বোঝেন।"

news