দিল্লিতে ‘৬০০ বছরের প্রাচীন মসজিদ’ যে কারণে ভেঙ্গে দিল কর্তৃপক্ষ

মাদ্রাসাসহ প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো আখুন্দজি মসজিদটাই সপ্তাহ দুয়েক আগে বুলডোজার দিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা ডিডিএ।

 বিবিসি জানায়, দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা ডিডিএ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একটি সংস্থা। তারা বলছে, ওই মসজিদটি অবৈধভাবে বনাঞ্চল দখল করে ছিল।

মসজিদ পরিসরেই অবস্থিত এক সুফি সাধকের মাজারও ভেঙে দেওয়া হয় ৩০ জানুয়ারি।


দিল্লিতে যে সাতটি মধ্যযুগীয় এলাকা রয়েছে, মেহরৌলি তারই অন্যতম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা প্রাচীন সৌধ আর স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ। বিখ্যাত কুতুব মিনারও এই মেহরৌলি অঞ্চলেই। আবার সেখানেই ৭৮৪ একর জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বনাঞ্চল ‘সঞ্জয় বন’।

ডিডিএ এক বিবৃতিতে বলেছে যে মসজিদটি একটি ‘অবৈধ কাঠামো’ ছিল, যা ‘বিনা বাধায়, কোনও সমস্যা ছাড়াই’ ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

তবে মসজিদের ইমাম জাকির হুসেন এবং তাদের আইনজীবী শামস খাজা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন যে সম্পত্তিটি দিল্লি ওয়াকফ বোর্ডের অধীন। ওই ওয়াকফ বোর্ডই শহরে ইসলামিক সম্পত্তিগুলি রক্ষণাবেক্ষণ করে।

জাকির হুসেন দাবি করেছেন যে কাঠামোটি ভেঙে ফেলার আগে তাদের লিখিত নোটিশ দেয়নি ডিডিএ। তিনি আরও অভিযোগ যে কয়েকটি কুরআনও নষ্ট হয়েছে, শিশুদের জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে দেওয়া হয় নি। আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, যেসব নথি ছিল মসজিদে, যা দিয়ে প্রমাণ করা যেত যে মসজিদটি অবৈধ ভাবে দখল করা জমিতে অবস্থিত ছিল না, সেসবও বেআইনি ভাবে নিয়ে নেওয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে।

জাকির হুসেন বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের শীতের মধ্যে বার করে দেওয়া হয়েছে। এখন প্রার্থনা করা ছাড়া কিছুই করতে পারছি না আমরা।

ডিডিএ অবশ্য সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে যে মসজিদটি যে জমিতে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা তাদের এলাকা।

ডিডিএ-র উদ্যান বিভাগের প্রধান কমিশনার রাজীব কুমার তিওয়ারি বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল সাফ করার সময় কিছু বই পেয়েছি এবং আমরা মসজিদ কর্তৃপক্ষকে সেগুলো আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যেতে বলেছি।’

 মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলার পর থেকে কর্তৃপক্ষ মেহরৌলির আরও কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে, যার মধ্যে দিল্লির প্রথম সুফি সাধকদের একজনের মাজারও রয়েছে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।

সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ এবং ইতিহাসবিদরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এ ঘটনায়।

তারা বলছেন, শত শত বছরের পুরনো স্থাপনাগুলিকে কী ভাবে অবৈধ তকমা দেওয়া যায়?

তাদের আরও অভিযোগ যে পরিকল্পিত ও অন্যায়ভাবে মুসলিম সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলিকেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে।

তবে ডিডিএ জানাচ্ছে, ‘সঞ্জয় বন’-এ যে ২০টি ধর্মীয় কাঠামো সরিয়ে দেওয়া হবে, তার মধ্যে ১৬টি মাজার এবং চারটি মন্দির রয়েছে।

"স্পষ্টতই একটি প্যাটার্ন উঠে আসছে এবং এটি দেশের জন্য বিপজ্জনক নজির স্থাপন করছে যেখানে সব ধর্মকে সমানভাবে বিবেচনা করার কথা,” বলছেন ইতিহাসবিদ সোহেল হাশমি।

কিন্তু ডিডিএ-র কর্মকর্তা তিওয়ারি বলেন, ‘পুরোপুরি আইনি’ পদক্ষেপকে অহেতুক ধর্মীয় রং দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে ডিডিএ প্রায়শই মন্দির সহ সরকারি জমিতে জবরদখল হটানোর কাজ করে এবং মসজিদ যেদিন ভাঙ্গা হয়েছে সেই একই দিনে অন্য এলাকায় পাঁচটি মন্দিরও ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

আমরা শুধু আমাদের কাজ করছি’ তিনি বলেন।

মসজিদের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা বলছেন, মসজিদটি ভাঙা হবে, এমন কোনও ঘোষণা আগে থেকে করা হয় নি। ভাঙ্গা শুরুর সময়ে তাই বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

বিবিসি নয়জন শিশুর সঙ্গে কথা বলেছে, যারা জানিয়েছে, ভোর ৫টায় তারা যখন সকালের নামাজের জন্য ঘুম থেকে উঠেছিল, তখনই তারা বিকট শব্দ শুনতে পায়।

তাদেরই একজন ওমরের মনে আছে, কয়েক ডজন পুলিশ, কয়েকটি বুলডোজার এবং "কিছু রাগী চেহারার লোক চিৎকার করে আমাদের বাইরে আসতে বলছিল।“

এমন সময় ইমাম সাহেব ছুটে এলেন। 'দৌড়াও, পালাও' বলে চিৎকার করে ওঠেন তিনি।

যা পাও নিয়ে দৌড়াও,’ শিশুদের উদ্দেশ্যে বলেন তিনি।

মসজিদটির ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না - কেউ কেউ বলেন যে এটি ত্রয়োদশ শতকে রাজিয়া সুলতানা নির্মাণ করেছিলেন, যাকে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী মুসলিম শাসক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

আবার কেউ কেউ বলছেন, এর বয়স আরও বেশি হতে পারে। হাশমি বলেন, কাঠামোটিতে ধূসর পাথরের ব্যবহার এই ইঙ্গিত দেয় যে এটি প্রায় ৬০০-৭০০ বছর আগে সুলতানি আমলে নির্মিত।

[২৮] আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) নথি থেকে জানা যায়, ১৮৫৩ সাল নাগাদ শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের আমলে মসজিদটির সংস্কার করা হয়।

ঐতিহাসিক রানা সাফভির কথায়, মসজিদটিতে সম্রাটের নিজের লেখা একটি শিলালিপিও ছিল। বেশিরভাগ কাঠামোর সংস্কার করা হলেও, মিজ সাফভি বলেন যে মসজিদটি এখনও ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন, যা সংরক্ষণ করা উচিত ছিল।

“সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, যে মসজিদটির সঙ্গে শেষ মুঘল সম্রাটের ইতিহাস জড়িয়ে আছে, সেটা কী করে গুরুত্বহীন হয়ে গেল?” প্রশ্ন রানা সাফভির।

তিওয়ারি বলেন, ‘ভবনটি ভেঙ্গে দেওয়ার পরে আমরা জানতে পেরেছি যে ঐতিহাসিকরা এরকম দাবি করছেন।’ তার কথায়, ‘ভবনটিকে বেশ আধুনিকই দেখাচ্ছিল, মোটেও অত পুরনো ছিল না। আমরা জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে ঘোষিত স্মৃতিসৌধগুলি সংরক্ষণ করি, তবে এই ভবনটি নিয়ে এরকম কোনও রেকর্ড নেই।’

তবে ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন যে বনটি সংরক্ষিত অরণ্যের মর্যাদা পাওয়ার অনেক আগে থেকেই মসজিদটির অস্তিত্ব ছিল তাই এটিকে জবরদখল হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। তাঁদের আশঙ্কা, এই ধরনের পদক্ষেপ মেহরৌলির অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনাকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

সোহেল হাশমি বলেন, “বনাঞ্চল যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে বনাঞ্চল আর তার ভেতরে থাকা ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলির মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব হওয়া উচিত নয়। দুটোই সংরক্ষণ করা দরকার।".

দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা ডিডিএ ২০২৩ সালে হাইকোর্টে তাদের বক্তব্য জানাতে গিয়ে বলেছিল যে তারা মেহরৌলিতে দিল্লি ওয়াকফ বোর্ডের মালিকানাধীন মসজিদ, কবর এবং অন্যান্য বৈধ সম্পত্তি ভাঙবে না কারণ সেগুলির ধর্মীয় তাৎপর্য আছে।

গত সপ্তাহে ডিডিএ জানায়, মসজিদ ভাঙার ব্যাপারে একটি ধর্মীয় কমিটি 'অনুমোদন দিয়েছিল’।

মসজিদ কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে আদালতে অভিযোগ করেছে যে ডিডিএ কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। ওই রায়ে ডিডিএকে বলা হয়েছিল যে ওই এলাকায় যে কোনওরকম ভাঙ্গাভাঙ্গি করার আগে ওয়াকফের মালিকানাধীন জমিগুলি চিহ্নিত করতে।

news