আসল ২১ জুলাই, সেদিন মমতাকে যেমন দেখেছি! ব্রিটিশরাজ ফিরিয়ে এনেছিল পুলিশ
ব্র্যাবর্ন রোডে টি-বোর্ড আর ইউকো ব্যাঙ্কের উল্টো দিকে চার রাস্তার ক্রসিংয়ের ট্রাফিক স্ট্যান্ডের মধ্যে তখন দুই হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে বসে সৌগত রায় (Sougata Roy)। তাঁর পিঠে পুলিশের লাঠি পড়ছে অনবরত। সাদা পোশাকের ভদ্রলোক শেষে পিস্তল বের করে আকাশের দিকে তাক করে বলে উঠলেন, ‘আমি কিন্তু এবার গুলি চালাতে বাধ্য হব। আমি এমএলএ সাহেবের বডিগার্ড। এসবি-তে (স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ) আছি।’ পরে জেনেছিলাম, ওই পুলিশ কর্মীর নাম কল্যাণ চক্রবর্তী। (21 July)
তাঁর কথা শুনে উন্মত্ত পুলিশ রণে ভঙ্গ দিল। তারা ছুট লাগাল অন্যদিকে। ব্র্যাবোর্ন রোড ততক্ষণে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। একদিকে, যুব কংগ্রেস (Youth Congress) কর্মীদের ইটবৃষ্টি, অন্যদিকে, মুহুর্মুহু পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের সেল ছুটে আসছে। সঙ্গে অবিরাম লাঠিচার্জ। তারমধ্যেই হাওড়া ব্রিজের দিক থেকে পিল পিল করে লোক ঢুকছে। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ছত্রাকার। তারা খানিক দিশেহারা। সেই কারণেই মরিয়া। সেখান থেকে বাস্তবিকই ঢিল ছোঁড়া দূরে রাইটার্স বিল্ডিংস। বিক্ষোভকারীদের যে করে হোক আটকাতে হবে, এমনটাই নির্দেশ, বলে দিচ্ছিল পুলিশের আচরণ।
তাদের কাছে খবর ছিল বিক্ষোভকারীরা যেন তেন ভাবে রাইটার্সে ঢুকে বসে পড়ার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। অতএব ব্র্যাবোর্ন রোডে আটকে রাখতেই হবে বিক্ষোভকারীদের। মেয়ো রোড এবং এসপ্ল্যানেড ইস্টেও জমায়েত করেছিল অভিযানকারীরা। ওই দুই জায়গা থেকে রাইটার্স বিল্ডিংস অনেকটাই দূরে। তাই ব্র্যাবোর্ন রোডের জমায়েতকারীদের আটকানো পুলিশের কাছে ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আমরা সাংবাদিকেরা সেই পরিস্থিতির মধ্যেই কোনওরকমে গা বাঁচিয়ে চারদিকে নজর রাখছি। নোট নিচ্ছি। হঠাৎ জানতে পারলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্র্যাবোর্ন রোডে চলে এসেছেন।
সেদিন সকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাঁর বাড়ির কাছে তখনই বহু মানুষের ভিড়। মহাকরণ অভিযানে যাওয়ার পথে কালীঘাটে নেত্রীর বাড়ি দেখতে চলে এসেছে মানুষ। দেখা মানে দর্শন করা বলা চলে। তখন এমনই জনপ্রিয়তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। লোক মুখে তিনি তখন ‘অগ্নিকন্যা’। মিডিয়ার চোখে ‘পটুয়াপাড়ার অগ্নিকন্যা’, দলে ঈর্ষাকাতর নেতাদের চোখে ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, আর শাসকের চোখে ‘ওই অসভ্য মহিলা’। কিন্তু ততদিনে প্রতিবাদের নাম হয়ে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ট্রেনের কামরায় নিত্য গোলমালে গলা চড়িয়ে প্রতিবাদী মহিলা যাত্রীর উদ্দেশে সদলবল পুরুষযাত্রীর মন্তব্য ধেয়ে আসে, ‘বাবা! এতো দেখছি মমতা ব্যানার্জি।’ কাঁকুড়গাছির বস্তিতে নিত্য মদের আড্ডা, মেয়েদের ধরে টানাটানি, রাতভর বোমাবাজির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মহিলা মহল্লার দাদাদের দিকে ঝাঁটা উঁচিয়ে বলেন, ‘আসছে মমতা। মজা দেখাবে তোদের।’ হাসপাতালের আউটডোরে ঘেমে-নেয়ে একশা ভিড় থেকে বেলা গড়িয়ে হেলতে দুলতে আসা ডাক্তারবাবুর উদ্দেশে কেউ বলে ওঠেন, ‘একদিন মমতা ব্যানার্জি এলে এরা সব শায়েস্তা হয়ে যাবে।’ পুলিশের লাঠির আঘাতে জখম তরুণ সেই পুলিশকেই বলে, ‘আপনার ভাগ্য ভাল। দিদি এখানে থাকলে আজ বুঝতেন কত ধানে কত চাল।’ সে সব দিনে যাদবপুরে সিপিএমের এক মহিলা নেত্রী বিরোধীদের কথায় কথায় চমকান, ধমকান। লোকে বলতে লাগল, ‘সিপিএমের মমতা’, ‘নকল মমতা’ ইত্যাদি।
অফিস থেকে সেদিন বলা হয়েছিল, শহর ঘুরে যা দেখলাম, তা সিনিয়রদের কিছুক্ষণ পর পর জানাতে। হাতের কাছে কোনও পিসিও বুথ সেদিন খোলা পেলাম না। পিসিও অর্থাৎ পাবলিক কল অফিসের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। পথেঘাটে পয়সা দিয়ে ফোন করার ব্যবস্থা। তখন মোবাইল আসেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে একটি মাত্র ল্যান্ড ফোন ভরসা। গিয়ে দেখি সেটি তখন সাংবাদিক প্রবীর ঘোষালের দখলে। তিনি অনেকক্ষণ পর ফোন রেখে বললেন, ‘গোটা কলকাতাই আজ ব্রিগেড (ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড), বুঝলে।’ এদিকে, ঘন ঘন ওই ফোন বাজতে শুরু করেছে। বুঝে গেলাম, ওটার আর নাগাল পাওয়া যাবে না এখন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে অফিস হয়ে তারপর গেলাম ব্র্যাবর্ন রোড। সেখানে একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। ভিড়ে ঠেলে, পুলিশের লাঠি, টিয়ার গ্যাসে চোখের জল মুছতে মুছতে সেখানে পৌঁছে শুনলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি পরে অভিযোগ করেন, মঞ্চে উঠে পুলিশ তাঁকে রাইফেলের বাট দিয়ে কোমরে মেরেছে। তার মধ্যে পুলিশ নাগারে কাঁদানে গ্যাসের সেল ছুঁড়তে থাকে। তাঁকে মঞ্চের নিচে নামিয়ে আনার পরও পুলিশ তাঁর দিকে বন্দুকের নল তাক করে ছিল। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী মাইতিবাবু সার্ভিস রিভলবার বের করে বলেন, বাড়াবাড়ি হচ্ছে। এবার আমি কিন্তু বাধ্য হব গুলি চালাতে।
প্রাক্তন সাংসদ, বর্তমানে তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র কুণাল ঘোষ তখন মাঠে-ময়দানে দৌড়ঝাঁপ করা পুরোদস্তুর সাংবাদিক। আমি ও কুণাল এক কাগজে কাজ করি তখন। ওঁর উপস্থিত বুদ্ধি, পাঁচজনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার কেরামতি ছিল ঈর্শনীয়। ছাত্র রাজনীতি করার বাড়তি সুবিধা ছিল ওঁর ছিল। তিন দশক আগে তরুণ বয়সেও দল নির্বিশেষে নেতাদের সঙ্গে কুণালের ব্যক্তিগত আলাপ পরিচয় ছিল দেখবার মতো। বাংলার কংগ্রেস তখন কালীঘাট আর আমহার্স্ট স্ট্রিটে বিভক্ত। মুখ দেখাদেখি বন্ধ রাজ্য কংগ্রেসের দুই মহারথী কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর আমহার্স্ট স্ট্রিটে সোমেন মিত্রর। দুই বাড়িতেই কুণালের প্রবেশ অবাধ। মুহূর্তে পাতার পর পাতা লিখতে পারার গুণটিও ছিল হিংসে করার মতোই।
অসুস্থ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধরাধরি করে রাস্তার এক ধারে পার্ক করা একটি অ্যাম্বাসাডরে তোলা হয়। নেতা-মন্ত্রী থেকে আম-জনতা, তখনও চারচাকা বলতে অ্যাম্বাসাডরের চল বেশি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গাড়িতে তোলার পর কুণাল ঝপ করে সেই গাড়িতে উঠে পড়ল। গাড়ির একটি দরজা খোলা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পিছনের সিটে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর পা দুটি বাইরে বেরিয়ে আছে। সেই অবস্থায় গাড়ি চলতে শুরু করে। খোলা পাল্লাটির অন্য একটি গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে। ফলে সেটি ফিরে এসে সজোরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পায়ে ধাক্কা মারে। তাঁকে প্রথমে এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে।
ব্যাবোর্ন রোড থেকে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক পরে এসএসকেএম হাসপাতালে গেলাম। যাওয়ার পথেই ময়দান এলাকায় খবর পেলাম, মেয়ো রোড, এসপ্ল্যানেড ইস্টে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। বহু মানুষ হতাহত। তাদের এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ময়দান চত্ত্বর জুড়ে তখনও বিশৃঙ্খলা চলছে। তবে পুলিশ খানিক আড়ালে, সন্ত্রস্ত। রাস্তা জুড়ে পড়ে অসংখ্য জুতো, ইট, পাথরের টুকরো, পুলিশের লাঠিও। রাস্তায় অনেক জায়গায় রক্ত গড়াচ্ছে। শুনলাম, ব্র্যাবোর্ন রোড যাওয়ার পথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে এখানে এসেছিলেন।
আমাদের বিপদ হল, বিক্ষোভকারীদের একদল প্রেস (Press) স্টিকার সাঁটা গাড়ি দেখলেই তেড়ে আসছে। সংবাদপত্র তাদের চোখে সেদিন সিপিএমের দালাল। মিডিয়া কথাটি আজকের মতো তখন চালু শব্দ ছিল না। সংবাদমাধ্যম বলতে ছিল সরকারি প্রচারমাধ্যম আকাশবাণী ও দূরদর্শন এবং বেসরকারি মালিকানাধীন ডজনখানেক খবরের কাগজ।
বিক্ষোভকারীদের ভয়ে প্রেস স্টিকার খুলে ফেলাও বিপদ। আন্দোলনকারী সন্দেহে পুলিশ গাড়ি-সহ আটকে দিতে পারে। কোনওরকমে এসএসকেএম হাসপাতালে গিয়ে দেখি ইমার্জেন্সিতে পা রাখার জায়গা নেই। হাসপাতাল চত্ত্বর লোকে লোকারণ্য। উডবার্ন ওয়ার্ডের সামনে ভিড় বেশি। কংগ্রেস, যুব কংগ্রেসের নেতারা একে একে আসছেন। পুলিশের ওয়্যারলেসে লালবাজার জানতে চাইছে, ম্যাডামের চোট-আঘাত কতটা।
ইমার্জেন্সির বাইরে কেউ ভাই, কেউ দাদা, কেউ বন্ধুর খোঁজ করছেন। ক’জন মারা গিয়েছে, মৃত, আহতদের নাম-ঠিকানা কী, এসব জানতে চেয়ে শয়ে শয়ে মানুষ আর্তনাদ করছে। এসএসকেএমে তখন কোনও পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম ছিল না। পুলিশের মাইকে অনুরোধ করা হচ্ছিল ইমার্জেন্সি খালি করে দিতে। পরিস্থিতি এমন যে ভিতরে ঢুকে জানার সুযোগ হল না ইমার্জেন্সিতে আহতদের চিকিৎসা হচ্ছে কি না বা সেখানে কোনও ডেড বডি আছে কিনা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর অনেকগুলি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেন। সেগুলির অন্যতম হল ২১ জুলাই কমিশন। ওড়িশা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কমিশনের কাজ সম্পন্ন করে যথাসময়ে সরকারের হাতে রিপোর্ট তুলে দেন। তাতে তিনি বলেছেন, ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই তৎকালীন রাজ্য যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে মহাকরণ অভিযান কর্মসূচি ঘিরে এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যা মোকাবিলা করতে পুলিশকে গুলি চালানোর দরকার ছিল। তিনি সেদিনের গুলিচালনাকে অসাংবিধানিক বলেছেন।
গুলি না চালিয়ে যে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যেত তার প্রমাণ ব্র্যাবোর্ন রোড। সেখানে সেদিন ডিউটিতে ছিলেন কলকাতা পুলিশের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার চয়ন মুখোপাধ্যায়। রাজ্য ক্যাডারের এই পুলিশকর্তা পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত ডিজি হয়েছিলেন। ঠাণ্ডা মাথায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁর মতো দক্ষ অফিসার কম ছিল। ব্র্যাবোর্ন রোডে তিনি সেদিন পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেননি। যদিও পরিস্থিতি যে ভয়াবহ ছিল তার প্রমাণ সেখানে ১৩৩ রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের সেল ফাটাতে হয়েছিল পুলিশকে।
তখন দেশে, রাজ্যে মানবাধিকার কমিশন ছিল না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যাত্রা শুরু করে সে বছর অক্টোবরে। পরের বছর চালু হয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই দেশে মানবাধিকার কমিশন থাকলে হয়তো আরও আগেই পুলিশের আচরণ দেখে বলত, বাংলা ব্রিটিশের শাসনে ফিরে গিয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ে পুলিশের গুলিচালনা রাজনীতির ইস্যু হয়নি। কারণটা দু’ভাবেই ব্যাখ্যা করা চলে। এক. পুলিশ সংযত। দুই. বিরোধীদের আন্দোলন এমন পর্যায়ে যায়নি, যে পুলিশ সংযম হারায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ে পুলিশ শূন্যে গুলি ছুঁড়েছে বেশি। সেটাও আইন-শৃঙ্খলা মোকাবিলায় নয়, শ্মশানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অন্তেষ্টিতে।
সেদিন বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একদল লোক প্রথম থেকেই আক্রমণাত্নক ছিল। যেন গোলমাল বাঁধানোর পরিকল্পনা করেই এসেছিল তারা। তারা যুব কংগ্রেসের সমর্থক নাকি সিপিএম ভাড়াটে সেনা ঢুকিয়ে রেখেছিল, তা নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। তবে শুধু তাদের মোকাবিলা করতে পুলিশ সেদিন গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। আসলে সব মানুষ সেদিন পুরোমাত্রায় অহিংস অবস্থায় সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলেও পুলিশের সাধ্য ছিল না তাদের আটকায়।
একে তো সেই সময়ে কলকাতায় পুলিশ ছিল নামমাত্র। রাজ্য পুলিশের কাছ থেকে ধার করা পুলিশ দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলন সামাল দিতে হত। সেদিনও তাই করতে হয়েছিল লালাবাজারের কর্তাদের। দ্বিতীয়ত, জনতার মুড ছিল ‘মহাকরণ দখল’। পরে জানা যায়, লালবাজার, রাইটার্স বিল্ডিংসের কর্তারাও ভিড় দেখে চমকে যান। গোয়েন্দা রিপোর্টে এমন ভিড়, ভিড়ের চরিত্রের আভাস, কিছুই ছিল না।
সেই ভিড় লালবাজার আর রাইটার্স বিল্ডিংসের কর্তাদের চিন্তায় ফেলল তাই-ই শুধু নয়, রাজ্য কংগ্রেসের নবীন, প্রবীণ সব নেতাই বুঝে গেলেন, সরকার বদলাতে হলে আগে বদলাতে হবে তাঁদের। মমতার পথে রাজপথে লড়াইয়ের বিকল্প নেই। ততদিনে যদিও তাঁদের অনেকেরই শরীর মন দুই-ই ভারী হয়ে গেছে। বিশ্বাসযোগ্যতাও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল।
রাজ্য যুব কংগ্রেস সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেদিন, অর্থাৎ ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই একাধিক ইস্যুতে রাইটার্স বিল্ডিংস অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন। সেই অভিযানের প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল মাস সাতেক আগের একটি জনসভা। ২৫ নভেম্বর, ১৯৯২। যুব কংগ্রেসের নামে ডাকা হলেও ব্রিগেডের সেদিনের সমাবেশের ছিল ব্যক্তি মমতার ডাকে জমায়েত সভা। সিপিএম, কংগ্রেস ছাড়া কোনও দল ব্রিগেডে সভা করার কথা ভাবতে পারত না তখন। ‘বামফ্রন্টের মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর’ সেই সমাবেশে এতই ভিড় যে চারদিনের মাথায় বামফ্রন্টের সমাবেশের স্লোগান উঠল, ‘আয় দেখে যা মমতা বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতা’, ‘আয় দেখে যা মমতা, জ্যোতি বসুর (Jyoti Basu) ক্ষমতা’ ইত্যাদি। শাসক দলই বুঝিয়ে দিল, লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গে নয়, মমতার বিরুদ্ধে।
মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর সেই সভার পরের কর্মসূচি ছিল মহাকরণ অভিযান। প্রধান ইস্যুটি ছিল ‘নো কার্ড নো ভোট’। দেশের তৎকালীন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন শেসনও তখন সরকারকে বোঝাতে ব্যস্ত, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সচিত্র পরিচয়পত্র চালু করা জরুরি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি ছিল, এপিক ছাড়া ভোট নয়।
ভোটে এপিক বাধ্যতামূলক হয়েছে অনেক বছর হল। এ দেশের নির্বাচনী সংস্কারে সেটাই এ যাবৎ সবচেয়ে বড় সংস্কার, যার সঙ্গে জুড়ে আছে একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা, একজন রাজনীতিক এবং একটি রক্তক্ষয়ী আন্দোলন—২১ জুলাই, ১৯৯৩। (21 July, Sahid Diwas)
আরও দুটি কারণে দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। ওই আন্দোলনের সুবাদে বাংলায় সিপিএম বিরোধী রাজনীতির স্রোতমুখ হয়ে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলা চলে, ওই দিনেই নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় রাজনীতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ওই দিনেই বীজ বপন হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের। পাঁচ বছরের মাথায় যে দলের জন্ম হল এমন নারীর হাত ধরে, রাজনীতিতে যিনি সেলফ-মেড উওম্যান। ইন্দিরা গান্ধী তো ননই, মমতার সমসাময়িক জয়ললিতা, মায়াবতী, সুষমা স্বরাজ, শীলা দীক্ষিত, কাউকে তাঁর সঙ্গে এক পংক্তিতে রাখা যায় না। রাজনীতিতে যাঁরা কেউ বাবা, কেউ প্রেমিক, কেউ শ্বশুর, কেউ গুরুর হাতে লালিতপালিত।
’৯৩-এর ২১ জুলাই স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলার রাজনীতিতে এক অচলায়তনেরও অবসান হল। রাজনীতির নির্ধারক হয়ে উঠলেন একজন মহিলা। বিরোধী নেতা শব্দটির জায়গা নিল বিরোধী নেত্রী কথাটি।
বাংলায় কংগ্রেস এবং বাম শিবিরে মহিলারা ছিলেন। কিন্তু রাজ করত পুরুষতন্ত্র। মমতার সেদিনের অভিযান এবং পাঁচ বছরের মাথায় নিজে দল তৈরি না করলে এই অচলায়তন আজও ভাঙত কিনা সন্দেহ।।খবর দ্য ওয়ালের /এনবিএস/২০২২/একে