'ধর্মান্তর এবং বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের কারণে দেশে জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে'

ভারতে উগ্রহিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবলে বলেছেন, ধর্মান্তর এবং বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের কারণে দেশে জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে।

তিনি বলেন, জনসংখ্যা নীতিকে সর্বজনীনভাবে বিবেচনা করা উচিত এবং এমন একটি জনসংখ্যা নীতি তৈরি করা উচিত যা সকলের জন্য প্রযোজ্য। 

এর আগে, গত বিজয়াদশমীতে, ‘আরএসএস’ প্রধান মোহন ভাগবত জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং এমন একটি নীতির পক্ষে সাফাই দিয়েছিলেন যা সকলের জন্য প্রযোজ্য হয়। 

গতকাল (বুধবার) এক সংবাদ সম্মেলনে আরএসএস নেতা দত্তাত্রেয় হোসাবলে ধর্মান্তর বিরোধী আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করার আহ্বান জানান।  তিনি বলেন, 'ঘর ওয়াপসি' ভালো ফল দিয়েছে। 'ঘর ওয়াপসি' হল সঙ্ঘ পরিবারের একটি প্রচেষ্টা যারা ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন তাদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা।

হোসাবলে বলেন, ধর্মান্তর বন্ধ করার জন্য আইন করা হয়েছে, কিন্তু এই আইনগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করা দরকার। তিনি উত্তরপ্রদেশ সহ কিছু রাজ্যের সংশ্লিষ্ট আইনের প্রেক্ষাপটে ওই মন্তব্য করেন, যে আইনে বলপ্রয়োগ বা প্রলোভনের মাধ্যমে ধর্মান্তরকরণ নিষিদ্ধ।   তিনি বলেন, ধর্মান্তরের কারণে হিন্দুদের সংখ্যা কমছে এবং জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতার কারণে অনেক দেশে বিভাজনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ভারত ভাগও হয়েছে জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতার কারণে। তাই সবার জন্য প্রযোজ্য জনসংখ্যা নীতি থাকা উচিত। জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতার দ্বিতীয় কারণ হল ‘অনুপ্রবেশ’। বাংলাদেশ হয়ে উত্তর বিহারের পূর্ণিয়া, কাটিহারের মতো  জেলাগুলোতেও এবং অন্যান্য রাজ্যে জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতা দেখা গেছে।  

জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতা প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ড. শাহাবুদ্দিন ইয়াকুব কুরেশি (এসওয়াই কুরেশি) আজ (বৃহস্পতিবার) বলেছেন, ‘আগে সংঘের লোকেরা বলত যে জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতা কারণ মুসলমানরা বেশি সন্তান জন্ম দেয়। তবে আমি খুশি যে গত দেড় থেকে দুই মাসে এখন এসব কথা শোনা যাচ্ছে না বরং তারা বলছে ‘ধর্মান্তর ও অনুপ্রবেশের কারণে’ জনসংখ্যার ভারসাম্যহীনতা ঘটছে। তিনি বলেন, ৫৩ শতাংশ মুসলিম পরিবার পরিকল্পনা করেন না, এমনকি ৪২ শতাংশ হিন্দুও পরিবার  পরিকল্পনা করেন না। এজন্য যদি মুসলিম দোষী হয়, তাহলে দুই নম্বরে একজন হিন্দুও দোষী। কিন্তু এটাকে দেশপ্রেমের চোখে দেখা উচিত নয়।’    

এসওয়াই কুরেশি সম্প্রতি ‘আরএসএস’ প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে দেখা  করেছিলেন। গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অনুপ্রবেশ অবশ্যই ঘটেছে এবং সরকার এই পরিসংখ্যান জানে। কিন্তু এত বড় দেশে দুই, চার বা ১০ লাখ মুসলমান এলে ভারসাম্য খুব একটা বিঘ্নিত হবে না। তিনি বলেন, হ্যাঁ এমন হতে পারে যে, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এর সামান্য প্রভাব পড়তে পারে, কিন্তু সমগ্র ভারতে এর প্রভাব পড়বে না।  ‘আরএসএস’কে নিশানা করে সাবেক মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এসওয়াই কুরেশি আরও বলেন, আপনাদের সরকার আছে, আপনারা অনুপ্রবেশ বন্ধ করুন। বরং বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারতীয় মুসলমানরা। বহু বছর ধরে আমরা শুনে আসছি প্রত্যেক মুসলমানকে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানি বলা হয়। সবচেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হয়েছে বাংলাভাষী মুসলমানদের ওপর। বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশী বলা হলেও সারা ভারতের মুসলমানদেরকেও জায়গায় জায়গায় বাংলাদেশী বলা হয় এবং আমরা শুনে আসছি, সেজন্য আগে আপনারা অনুপ্রবেশ বন্ধ করুন।’

তিনি বলেন, ‘শিক্ষা, আয় ও সেবা প্রদান বৃদ্ধির সাথে সাথে জনসংখ্যা হ্রাস পায়। কিন্তু শিক্ষা, আয় ও স্বাস্থ্য সেবার দিক থেকে মুসলমানরা সবচেয়ে পিছিয়ে।  জনসংখ্যা নীতির পাশাপাশি এই জনগণকে সচেতনতা ও অবকাঠামো দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। তাদের মধ্যে সচেতনতা ছড়ানোর কথা আছে, কিন্তু তাদের আয় বাড়ানোর কথা আছে? এটা করা হয় না বরং এটা করা হয়েছে যে তাদের সাথে ব্যবসা করা বন্ধ করে দাও এবং তাদের নেতারাও এমন বাজে কথা বলে যা দায়িত্বজ্ঞানহীন জাতীয়তা বিরোধী ও অসাংবিধানিক কাজ। যদি তারা আরও দরিদ্র হয় এবং আরও সন্তান উৎপাদন করে, তবে আপনাদের আরও অভিযোগ থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘আমি আমার একটি বই ‘আরএসএস’ প্রধান মোহন ভাগবতজীকে দিয়ে বলেছিলাম যে জনসংখ্যা নিয়ে অনেক কথা বলা হয়, যা ভুল। ধারণা দেওয়া হয় যে মুসলমানরা অনেক সন্তান উৎপাদন করে। আমি তাদের বলেছিলাম ভারত সরকারের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে ১৯৯১-৯২-এর যে তথ্য পাওয়া  গেছে, তাতে পার্থক্য শুধু একটি শিশুর। যা এখন ০.৩-এ নেমে এসেছে কারণ মুসলমানরা খুব দ্রুত পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। মুসলিমরা হিন্দুদের তুলনায় দ্রুত পরিবার পরিকল্পনা করছে, যার কারণে ব্যবধান কমে যাচ্ছে।’    

তিনি বলেন, আরেকটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে যে মুসলমানরা অনেক বিয়ে করে এবং অনেক স্ত্রী রাখে যা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ, ভারত সরকারের গবেষণা অনুসারে মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে কম বহুবিবাহ রয়েছে। ভারতে বৃহৎ পরিসরে বহুবিবাহ সম্ভব নয় কারণ সাম্প্রতিক আদমশুমারি অনুসারে লিঙ্গ অনুপাত প্রতি হাজার পুরুষে ৯৪০ জন মহিলা৷ এটি ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতি হাজারে ৬০ জন পুরুষ যখন বউ পাবে না, তখন একজন মুসলিম বা হিন্দু বা অন্য কোন সমাজের লোকেরা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্ত্রী পাবে কোথা থেকে?’ 

সাবেক জাতীয় নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি একটি ভালো ধারণা। যা সারা দেশের করা উচিত। মুসলমানদের পাশাপাশি আমরা সকল  কমিটিকে পরিবার পরিকল্পনা করার আবেদন জানাই। ভারতের অর্ধেক জনসংখ্যা  পরিবার পরিকল্পনা করে না। দেশে ভারসাম্যহীনতা কোথায় হয়েছে, বলুন কোথায় ভারসাম্যহীনতা? এটা সত্য যে, মুসলমানদের জন্মহার বেশি কিন্তু হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের জন্মহারের পার্থক্য মাত্র ০.৩ শতাংশ যা একটি শিশুর পার্থক্যও নয়। জনসংখ্যা নীতির অধীনে যারা পরিবার পরিকল্পনা করতে চান তাদের স্বাস্থ্য  সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টিও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি পরিবার পরিকল্পনা করতে ইচ্ছুক এবং তা করতে চায় কিন্তু পরিসেবা তাদের কাছে পৌঁছায় না’ বলেও মন্তব্য করেন সাবেক জাতীয় নির্বাচন কমিশনার ড.শাহাবুদ্দিন ইয়াকুব কুরেশি।

খবর পার্সটুডে/এনবিএস/২০২২/একে

news