স্বাগত ঋষি

 

 
এতদিনে বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল। ব্রিটিশরা দু’শো বছর ভারত শাসন করে ছেড়ে যাওয়ার সময় বলেছিল, এদেশের নেতারা নিতান্ত অপদার্থ। তাঁরা দেশ শাসন করার উপযুক্ত নন। ৭৫ বছর বাদে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত (Rishi Sunak) ব্রিটিশ প্রশাসনেরই শীর্ষ পদ অলংকৃত করতে চলেছেন।
কোভিড অতিমহামারীর পরে ব্রিটেনের অবস্থা খুবই খারাপ। অর্থনীতির হাল ফেরাতে না পেরে অল্পদিনের মধ্যে পদত্যাগ করেছেন দু’জন প্রধানমন্ত্রী। সংকট থেকে উদ্ধার পেতে আপাতত এক ভারতীয় বংশোদ্ভূতের ওপরেই ভরসা রাখছে ব্রিটেন। আর একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হল, বর্তমানে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিকও একজন ভারতীয়। তাঁর নাম সঞ্জীব মেহতা। আড়াইশ বছর আগে এই কোম্পানিই ভারত জয় করেছিল।
ঋষির ঠাকুরদা অবিভক্ত পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালায় জন্মগ্রহণ করেন। জায়গাটি এখন পাকিস্তানের অন্তর্গত। যৌবনে তিনি জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দেন আফ্রিকায়। তাঁর বাবা ছিলেন চিকিৎসক। মা ছিলেন ফার্মাসিস্ট। তাঁরা আফ্রিকা ছেড়ে ব্রিটেনে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। ঋষি পড়তেন উইনচেস্টার প্রাইভেট কলেজে। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। অতীতে আরও কয়েকজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অক্সফোর্ডের ছাত্র ছিলেন।

ঋষি একসময় আমেরিকায় গোল্ডম্যান সাচস সংস্থায় উঁচু পদে ছিলেন। পরে ব্রিটেনে কিছুদিন হেজ ফান্ড ম্যানেজার হিসাবে কাজ করতেন। ২০১৫ সালে প্রথমবার ব্রিটেনের এমপি হন। পরের বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেন। ২০১৮ সালের শুরুতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে তাঁকে জুনিয়র মিনিস্টার হিসাবে নিয়োগ করেন। ২০২০ সালে অতিমহামারী শুরু হওয়ার পরে তাঁকে রাজকোষের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২২ সালের জুলাইতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেন। এর পরে সরকারের পতন ঘটে। 
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন মোট ১১ জন। তাঁদের মধ্যে এগিয়ে ছিলেন ঋষি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে লিজ ট্রাসের কাছে পরাজিত হন। ট্রাস কিন্তু ৪৪ দিনের বেশি সরকার চালাতে পারলেন না। আর্থিক মন্দার মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করলেন। ফের প্রধানমন্ত্রী হতে চেষ্টা করেছিলেন বরিস জনসন। পেনি মরড্যান্ট নামে আরও এক এমপি-ও ওই পদের প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিরোধিতা উড়িয়ে দিয়ে ঋষিই হতে চলেছেন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা।
ঋষির আর একটা পরিচয় হল, তিনি ইনফোসিসের কর্ণধার নারায়ণমূর্তির জামাই। তিনি ও তাঁর স্ত্রী অক্ষতা ব্রিটেনের অন্যতম ধনী দম্পতি। তাঁদের সম্পদের পরিমাণ ৭০ কোটি পাউন্ড। অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি।
গত কয়েক বছরে একাধিকবার নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন তাঁরা। একবার জানা যায়, অক্ষতা কৌশলে ব্রিটিশ সরকারকে কম ট্যাক্স দিয়েছেন। ইনফোসিসের শেয়ার থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ডের ওপরে তাঁর যে কর দেওয়ার কথা ছিল, তার থেকে দু’কোটি পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা কম দিয়েছেন। এরপরে জানা যায়, ২০২১ সাল অবধি ঋষি আমেরিকার গ্রিন কার্ডটি হাতছাড়া করেননি। তাঁর সমালোচকরা বলেছিল, প্রয়োজনে আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার রাস্তা খোলা রেখেছেন ঋষি। অর্থাৎ ব্রিটেনকে তিনি যথেষ্ট ভালবাসেন না। সেখানকার রাজনীতিতে ভাগ্যপরীক্ষা করতে এসেছেন মাত্র।
৪২ বছর বয়সি ঋষি কোনও নেশা করেন না। অতিমহামারী চলার সময় বরিস জনসনের জন্মদিনের পার্টিতে গিয়েছিলেন। কোভিড বিধি ভাঙার জন্য পুলিশ তাঁকে জরিমানা করেছিল। 
এইসব ছোটোখাটো অভিযোগকে এখন কেউ গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন শুনে চাঙ্গা হয়েছে ব্রিটেনের শেয়ার বাজার। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন অর্থনীতির ছাত্র ঋষি বর্তমান সংকট থেকে ব্রিটেনকে উদ্ধার করতে পারবেন।
ঋষির খবর শুনে খুশি হয়েছে ভারতও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইট করে বলেছেন, ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ালির শুভেচ্ছা জানাই। আশা করি এবার ২০৩০ সালের জন্য রোডম্যাপ তৈরি করতে সুবিধা হবে। আমলারাও অনেকে মনে করছেন, এবার ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে বিশেষ বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। দেওয়ালির মধ্যেই ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা থমকে আছে। ঋষি নিজে সাংবাদিকদের বলেছেন, ওই চুক্তি যাতে স্বাক্ষরিত হয়, সেজন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিসাবে ভারতের প্রতি ঋষির দুর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু তিনি চাইলেই কি সবকিছু পারবেন? তিনি একটি দক্ষিণপন্থী দলের নেতা। ভারত বা অপর কোনও দেশের সঙ্গে বেশি গলাগলি করতে গেলে তাঁর দলের এমপিরাই ক্ষেপে উঠবেন। সর্বোপরি অতিমহামারী পরবর্তী আর্থিক সংকট দূর করতে হলে ব্রিটেনের স্বার্থই সর্বাগ্রে প্রধানমন্ত্রীকে মাথায় রাখতে হবে।
একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বলে আমাদের উদ্বাহু নৃত্য করার কিছু নেই। তবে আশা করা যায়, আগামী দিনে ব্রিটেনের সঙ্গে ভারতের বোঝাপড়া আর একটু ভাল হবে। সেজন্য অবশ্য ভারত ও ব্রিটেন, দুই দেশের নেতাদেরই আরও পরিণতমনস্ক হওয়া প্রয়োজন। অতিমহামারীর পরে বিশ্ব জুড়েই আর্থিক সংকট চলছে। এই অবস্থায় অবাস্তব কিছু আশা করলে চলবে না। তবে ব্রিটিশ জনতার মতো আমরা ভারতীয়রাও এই শুভক্ষণে বলব, স্বাগত ঋষি। তিনি সফল হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছাপিয়েও আমরা আনন্দিত হব তাঁর পারিবারিক পরিচয়ের কথাটি মনে রেখে।

খবর দ্য ‍ওয়ালের /এনবিএস/২০২২/এক

news