গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও থামেনি ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন। দেশটি একযোগে চলছে পশ্চিম তীর, সিরিয়া ও লেবাননে অভিযান; যার ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে নতুন করে বেড়ে গেছে অস্থিরতার। আন্তর্জাতিক মহলের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের নীরব সমর্থনই ইসরায়েলের এই সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপ কিছুটা কমলেও ইসরায়েলের হামলা থামেনি। গাজার পাশাপাশি লেবানন, সিরিয়া ও পশ্চিম তীরে নিয়মিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিবেশী দেশগুলোকে দুর্বল ও অস্থিতিশীল রাখাই ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ নেতাদের ইসরায়েল সফর সত্ত্বেও, ইসরায়েলের আঞ্চলিক হামলা বন্ধে ওয়াশিংটন এখনো কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি। বরং ট্রাম্প প্রশাসন কেবল গাজার সীমিত পরিস্থিতিতেই মনোযোগ দিচ্ছে।

পশ্চিম তীর: দখদারির নতুন ষড়যন্ত্র
পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের দমন-পীড়নের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত শুধু এই অঞ্চলেই প্রাণ গেছে এক হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির। ইসরায়েল তাদের দখলকৃত জমি আরও পাকাপোক্ত করছে—জলপাই বাগানে প্রবেশে বাধা, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও হয়রানি এখন নিত্যদিনের ঘটনা।

ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ সম্প্রতি তার সমর্থকদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সাথে সংযুক্ত করার পরিকল্পনায় সমর্থন দেন। তার দাবি, ‘পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করতেই হবে, তাহলেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের বিপজ্জনক ধারণা থেকে মুক্তি মিলবে।’

সিরিয়া: সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ
সিরিয়ার দক্ষিণ সীমান্তেও ইসরায়েলি হামলার তীব্রতা বেড়ে গেছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলি সেনারা সীমান্ত ডিঙিয়ে অনুপ্রবেশ করছে। গত রবিবার সকালে দক্ষিণ সিরিয়ার কুনেইত্রা প্রদেশের আল-রাজানিয়া ও সাইদা আল-হানুত গ্রামে ঢুকে ইসরায়েলি বাহিনী সাময়িক চেকপোস্ট বসায়। সেখান থেকে এক রুটি বিক্রেতাকে আটক করে তারা পরে ছেড়েও দেয়।

জাতিসংঘে সিরিয়ার প্রতিনিধি ইব্রাহিম ওলাবি গত ২৪ অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে বলেন, ইসরায়েলকে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে এবং গোলান মালভূমিসহ সব দখলকৃত এলাকা ফেরত দিতে হবে।

লেবানন: শান্তিরক্ষী বাহিনীকেই লক্ষ্যবস্তু!
লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলেও নিয়মিত বিমান ও ড্রোন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। সোমবার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী  জানায়, তাদের টহল দলের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপের জবাব দিতে গিয়ে তারা একটি ইসরায়েলি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে। এরপর ইসরায়েলি ট্যাংকও শান্তিরক্ষীদের দিকে গুলি ছুড়েছে। তবে এ নিয়ে কোনো হতাহতের খবর এখনো মেলেনি।

গত রোববার বালবাকের নবি চিত ও দক্ষিণ লেবাননের নাকুরা এলাকায় দুই ব্যক্তি ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। ২০২৪ সালের নভেম্বরের যুদ্ধবিরতি চুক্তি সত্ত্বেও ইসরায়েল লেবাননের ভেতরেই অবস্থান নিয়ে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব হামলায় বেসামরিক নাগরিক হতাহতের পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে পুনর্গঠন কাজের যন্ত্রপাতিও।

ইসরায়েলের দাবি, হিজবুল্লাহর পুনর্গঠন কাজ বানচাল করতেই এসব অভিযান। কিন্তু লেবানন সরকারের বক্তব্য, এটি সরাসরি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন এবং তাদের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইসরায়েলকে জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে।

কিন্তু মার্কিন বিশেষ দূত টম ব্যারাক ইসরায়েলকে থামাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে লেবাননসহ গোটা অঞ্চলজুড়েই নতুন করে উত্তেজনা ও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে।

গাজা: যুদ্ধবিরতি কাগুজে ঘোষণা, বাস্তবে হামলা চলছেই
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স সম্প্রতি ইসরায়েল সফরে গিয়ে বলেছেন, ‘১০ অক্টোবরের যুদ্ধবিরতি আশাতীত ভালোভাবে মানা হচ্ছে।’ কিন্তু গাজার মাটিতে এর কোনো প্রতিফলন নেই। শনিবার রাতেই নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় একজন নিহত ও চারজন আহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে আল-আউদা হাসপাতাল।

যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে এখনও পর্যন্ত গাজায় প্রায় ১০০ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। ইসরায়েল রাফাহ সীমান্ত দিয়ে অসুস্থদের বের হওয়ার উপরেও কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে—এমনকি তৃতীয় স্তরের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীকেও চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে দেয়া হচ্ছে না।

সবমিলিয়ে, যুদ্ধবিরতির নামে কাগজে-কলমে শান্তি ঘোষণা করলেও গাজা, লেবানন ও সিরিয়া—সব fronts-ই ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য আবারও জ্বলে উঠছে, তবে এবার তার বিস্তৃতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ।

 

news