দ্বীপের মালিকানা নিয়ে চরম রাজনৈতিক উত্তেজনা এখন ভারতে। কচ্ছতিভু নামের এই দ্বীপটি কিন্তু কম পুরোনো নয়। জানা যায়, ১৪ শতকে একটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলেই এর সৃষ্টি। বঙ্গোপসাগরের পক প্রণালীতে শ্রীলঙ্কার নেদুনতিভু এবং ভারতের রামেশ্বরমের ঠিক মাঝে এর অবস্থান। দ্বীপটির আয়তন প্রায় ১৬৩ একর। ভারতের উপকূল (রামেশ্বরম) থেকে এটি ৩৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এবং শ্রীলঙ্কার জাফনা থেকে প্রায় ৬২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দ্বীপটিতে কোনো স্থায়ী বসতি নেই। তবে একটি পুরোনো গির্জা আছে, যার নাম সেন্ট অ্যান্থনি। প্রতি বছর সেখানে তিন দিনব্যাপী একটি জমকালো উৎসব হয়, যেখানে দুই দেশের মানুষই উৎসাহ নিয়ে অংশ নেন।

শ্রীলঙ্কার জাফনা এবং ভারতের তামিলনাডুর তামিল মৎস্যজীবীদের কাছে এই দ্বীপের গুরুত্ব বিশাল। মূলত মাছ ধরার কাজেই উভয় দেশের জেলেরা এর আশপাশের সমুদ্র এলাকা ব্যবহার করতেন। তবে এখন আর তারা সেখানে যেতে পারেন না। আর এখান থেকেই জন্ম নিয়েছে তীব্র ক্ষোভ। তবে এখনকার বিতর্ক ভারত-শ্রীলঙ্কার চেয়েও বেশি ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে নির্বাচনের ঠিক আগে এই বিতর্ক এখন চরম আকার ধারণ করেছে। এমনকি গত বছর এই রাজনৈতিক যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারত ও শ্রীলঙ্কা—উভয় দেশই বিভিন্ন সময়ে এই দ্বীপের মালিকানা দাবি করেছে। বারবার হাতবদল হয়েছে কচ্ছতিভুর নিয়ন্ত্রণ। ঐতিহাসিক প্রমাণ বলে, পর্তুগিজ, ডাচ্‌ এবং ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই দ্বীপটি শ্রীলঙ্কার অধীন ছিল। মধ্যযুগে এটি ছিল পাম্বান দ্বীপসহ জাফনা রাজ্যের অংশ। পরে ১৭ শতক থেকে এটি ভারতের মাদুরাই (বা মাদুরা) অঞ্চলের রামনাদ রাজ্যের অধীনে আসে। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হলে এটি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অংশ হয়ে যায়। তবে ১৯২১ সালে ভারত ও তৎকালীন সিলন (শ্রীলঙ্কার আগের নাম) একটি সীমানা নির্ধারণে সম্মত হয়, যা কচ্ছতিভুকে সিলনের ভূখণ্ডের মধ্যে রাখে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই দ্বীপটিকে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

স্বাধীনতার পর পরই শ্রীলঙ্কা কচ্ছতিভু দ্বীপটি নিজেদের বলে দাবি জানাতে শুরু করে। ১৯৫৫ সালে তৎকালীন সিলন (শ্রীলঙ্কা) বিমানবাহিনী কচ্ছতিভুতে সামরিক মহড়াও চালিয়েছিল। বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৬১ সালের ১০ই মে দ্বীপটিকে ‘তুচ্ছ’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেছিলেন, "এই ছোট দ্বীপের কোনো গুরুত্বই আমি দেখতে পাচ্ছি না। বন্ধুত্ব বজায় রাখতে এটির ওপর থেকে ভারতের দাবি তুলে নিতে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না।" তিনি মৌখিকভাবে শ্রীলঙ্কাকে কচ্ছতিভু দ্বীপে মাছ ধরা ও আসার অধিকারও দিয়েছিলেন।

এদিকে, শ্রীলঙ্কার ধারাবাহিক দাবির মুখে ১৯৬০ সালে ভারতের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম সি শিতলবাদ বলেছিলেন, কচ্ছতিভু দ্বীপের মালিকানা নিয়ে সব কিছু স্পষ্ট না হলেও এই দ্বীপের ওপর ভারতের অধিকার বেশি। তিনি দ্বীপটি ভারতের হাতেই রাখার পক্ষে মত দেন। অন্যদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব কে কৃষ্ণ রাও বলেছিলেন, কচ্ছতিভু নিয়ে শ্রীলঙ্কার দাবি বেশ মজবুত, তবে এর অর্থ এই নয় যে ভারতের কোনো দাবি নেই।

কিন্তু সব জল্পনার অবসান ঘটে ১৯৭৪ সালে। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দর নায়েকের অনুরোধে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একটি চুক্তির মাধ্যমে কচ্ছতিভু দ্বীপটি শ্রীলঙ্কার কাছে হস্তান্তর করে দেন।

ওই চুক্তিতে একটি শর্ত ছিল—ভারতীয় মৎস্যজীবীরা কচ্ছতিভু দ্বীপে বিশ্রাম নিতে, জাল শুকাতে এবং সেন্ট অ্যান্থনির বার্ষিক উৎসবে যোগ দিতে পারবেন। তবে ১৯৭৬ সালে হওয়া আরেকটি চুক্তিতে মৎস্যজীবীদের বিতর্কিত জলসীমায় মাছ ধরার অধিকার সম্পূর্ণরূপে কেড়ে নেওয়া হয়। তামিলনাড়ুর জেলেদের জীবিকার জন্য কচ্ছতিভু দ্বীপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় শ্রীলঙ্কার কাছে এটি হস্তান্তরের বিরুদ্ধে তামিলনাড়ুতে বহু আন্দোলন হয়েছে। এই ইস্যু সেখানে বারবার রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেস-বিরোধী দলগুলোর মূল দাবি ছিল, চুক্তিটি ভারতীয় মৎস্যজীবীদের দীর্ঘদিনের মাছ ধরার অধিকার লঙ্ঘন করেছে, তাই দ্বীপটি পুনরুদ্ধার করে ভারতের শাসন ফিরিয়ে আনা হোক। তামিলনাডুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা এবং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনও বহুবার দ্বীপটি ফেরত আনার দাবি জানিয়ে ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েছেন। সম্প্রতি তামিলনাডু বিধানসভায় এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবও পাস করা হয়েছে।

আসলে শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েক সরকারের পতনের পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। রামেশ্বরম, পুদুকোট্টাই এবং নগপত্তিনমের মতো এলাকার ভারতীয় জেলেরা কচ্ছতিভু দ্বীপের আশেপাশে গেলেই নির্যাতন, হামলা ও এমনকি হত্যার শিকার হচ্ছেন।

গত বছর লোকসভা নির্বাচনের আগে একটি আরটিআই (তথ্য জানার অধিকার) মারফত কিছু তথ্য সামনে আসে, যা এই পুরোনো বিতর্কে নতুন করে ঘি ঢেলেছে। এই ইস্যুটিকে পুঁজি করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরাসরি কংগ্রেসকে নিশানা করেছেন। তিনি বলেছেন, তৎকালীন কংগ্রেস সরকার নির্মমভাবে দ্বীপটি শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দিয়েছে। মোদি এই হস্তান্তরের জন্য কংগ্রেস এবং ডিএমকে—উভয়কেই দায়ী করেছেন। তবে বিরোধীরা পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে, বিজেপি সরকার গত ১০ বছরে দ্বীপটি ফিরিয়ে আনতে কী করেছে? অবশ্য ১৯৭৪ সালের চুক্তির বৈধতা নিয়ে ভারতের শীর্ষ আদালতে একটি মামলা এখনও বিচারাধীন রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, চুক্তিটি ভারতের সংসদে অনুমোদিত হয়নি এবং হস্তান্তরের আগে তামিলনাড়ু সরকারের সঙ্গেও কোনো আলোচনা করা হয়নি।

সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী হরিণী অমরাসুরিয়া তার প্রথম ভারত সফরে কচ্ছতিভু নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও, ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি মৎস্য এবং আঞ্চলিক সম্প্রীতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে কচ্ছতিভু ও পক প্রণালীর বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন। কিছুদিন আগেই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট দ্বীপটিতে সফর করেছেন। এর পরই শ্রীলঙ্কা সরকার ঘোষণা করেছে, সমস্যাটি “সমাধান করা হয়ে গিয়েছে।” তবে মাছ ধরার অধিকার, জীবিকা এবং আঞ্চলিক সীমানা নিয়ে আলোচনা এখনও চলছে।

এদিকে, সাবেক কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকরা মনে করেন, কচ্ছতিভুকে এখন শুধু একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের মতে, এর স্থায়ী সমাধানের দিকে সব পক্ষের মনোযোগ দেওয়া উচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্থানীয় মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকার বিষয়টি সবার আগে গুরুত্ব পাওয়া দরকার।

 

news