নদিয়ার পালপাড়া গ্রামে চলছে এক অদ্ভুত দৃশ্য—দীর্ঘ লাইন, কাগজপত্র হাতে উদ্বাস্তুদের মুখে উদ্বেগ আর আশার ছাপ। পেট্রাপোল সীমান্ত থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামে মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ-এর আওতায় আবেদন করতে। তাদের মধ্যে অনেকে ভয় পাচ্ছেন, নিবন্ধন না করলে হয়তো বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।
স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক অসিম সরকার তার পালপাড়ার বাড়ির একাংশকে পরিণত করেছেন সিএএ শিবিরে। সেখানে দলীয় স্বেচ্ছাসেবকরা আবেদনপত্র গ্রহণ করছেন, নথিপত্র যাচাই করছেন এবং আবেদনকারীদের সহায়তা দিচ্ছেন। অসিম সরকার জানিয়েছেন, পাঁচটি কেন্দ্রে এ ধরনের শিবির চলছে, এবং ইতিমধ্যেই প্রায় ৪০০ জন আবেদন জমা দিয়েছেন। তিনি নিজেই প্রতিদিন আবেদনকারীদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন ও স্বেচ্ছাসেবকদের তদারকি করছেন।
৫০ বছর বয়সী মিলন রায় জানান, তিনি বাংলাদেশের পতেঙ্গা থেকে ‘নির্যাতনের শিকার’ হয়ে পালিয়ে এসেছেন। তার ভাষায়,
“আমি জানতে এসেছি, কীভাবে সিএএ-এর জন্য আবেদন করতে হয়। শুনেছি যারা বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত, ভারত সরকার তাদের নাগরিকত্ব দেবে।”
তিনি বলেন, একজন দালালকে টাকা দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এসেছেন, এখন এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকেন।
“এক বছরেরও বেশি সময় হলো পরিবারের কাউকে দেখি না। নাগরিকত্ব পেলে অন্তত একটা কাজ পাবো, তারপর পরিবারকে আনতে পারবো।”
এমন আরও অনেকের গল্প মিলছে শিবিরে। রামচন্দ্র গায়েন (৫৫) জানান, ১৯৯৮ সালে স্ত্রী ও এক বছরের ছেলেকে নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন।
“আমার দোকান, ঘর, ভোটার কার্ড—সবই আছে। তবু শুনছি বাংলাদেশ থেকে যারা এসেছে, তাদের ফেরত পাঠাবে। টিভিতে দেখেছি দিল্লি থেকে কিছু মানুষকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। তাই এখনই আবেদন করছি।”
বিধায়কের অফিসের বাইরে বসেছিলেন এক তরুণ দম্পতি ও তাদের দুই বছরের সন্তান। তারা পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক।
“আমরা খুলনা থেকে এসেছি। সেখানে আর নিরাপদ না। জানতাম এটা একমুখী যাত্রা—ফিরবো না কখনো।”
শিবিরে স্বেচ্ছাসেবকরা আবেদনপত্র বিতরণ করছেন ও আবেদনকারীদের তথ্য পূরণে সাহায্য করছেন। ফর্মে নাম, পিতা-মাতা বা স্বামী-স্ত্রীর নাম, পেশা, ভারতে প্রবেশের সাল, বর্তমান ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে হচ্ছে। আবেদনকারীদের বাংলাদেশি উৎসের প্রমাণ ও ভারতে বসবাসের কাগজ জমা দিতে হয়। এছাড়া প্রতিবেশীর চরিত্র সনদ, আর যদি স্বামী বা স্ত্রী ভারতীয় নাগরিক হন, তবে তার পাসপোর্টের কপি দিতে হয়।
অসিম সরকার বলেন,
“২০০০ সাল থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত যাদের নাম নেই, তাদের নাগরিকত্বের আবেদন করতে উৎসাহ দিচ্ছি। মুখ্যমন্ত্রী উদ্বাস্তু হিন্দুদের ভুল পথে চালিত করেছেন। সিএএ আমাদের জন্য এক ‘লক্ষ্মণরেখা’।“
তার দাবি, গত দুই মাসে তার হরিণঘাটা এলাকায় প্রায় ৪০০ আবেদন জমা পড়েছে।
স্থানীয় অধিকারকর্মীদের মতে, ভয় আর গুজবই এই ভিড়ের মূল কারণ। গণমাধ্যমে ‘ডিটেনশন’ আর ‘ডিপোর্টেশন’-এর খবর ছড়িয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিজেপির অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, এই উদ্যোগ মতুয়া ও হিন্দু উদ্বাস্তু ভোটব্যাংক শক্ত করতে সহায়ক হবে।
অসিম সরকার দাবি করেন, এই শিবির ভুয়া ভোটার চিহ্নিত করতেও সাহায্য করবে—যদিও বিরোধীদের মতে, এটি নিছক রাজনৈতিক প্রচারণা।
তিনি আরও স্বীকার করেন, বহু আবেদনকারী প্রমাণপত্র ছাড়াই এসেছেন, ফলে প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়ছে। তবুও স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের সহায়তা দিচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
আবেদনকারীদের বলা হয়েছে রসিদ সংরক্ষণ করতে এবং সরকারি মাধ্যমের মাধ্যমে আবেদনপত্রের অগ্রগতি জানতে। তবে পালপাড়ার মানুষের উদ্দেশ্য একটাই—
“আমরা বাংলাদেশে ফিরতে চাই না,” বলেন রামচন্দ্র গায়েন।
“ওখানে এখন আমাদের কিছুই নেই। আমরা শুধু এখানে পরিবার নিয়ে থাকতে চাই, ভারতীয় নাগরিক হিসেবে।”
