এক সময় যিনি ছিলেন সারা বাংলাদেশের 'হিরো', আজ তিনি হয়ে পড়েছেন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেই উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার ক্যারিয়ার এখন রাজনীতির খেলায় শেষ হয়ে গেল। এক সময়ের এই 'জাতীয় গর্ব'কে আজ দেশেরই একজন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি আর কখনোই বাংলাদেশের জার্সি পরতে পারবেন না।

কীভাবে হারালেন 'হিরো' এর মর্যাদা?

দ্য ডিপ্লোম্যাট-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উঠে এসেছে সাকিবের উত্থান ও পতনের করুণ গল্প। দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত একটি দেশকে যখন তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরব এনে দিচ্ছিলেন, তখন তিনি ছিলেন তরুণ-প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পরই তিনি ছিলেন সবচেয়ে পরিচিত বাংলাদেশি।

কিন্তু সেই ছবিটা আজ বদলে গেছে। ২০২৩ সালে, তখনও সক্রিয় ক্রিকেটার থাকাকালীন, তিনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০২৪ সালের যে নির্বাচনে তিনি দলীয় প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান, সেই নির্বাচনকেই দেশ-বিদেশে 'একপক্ষীয় ও কারচুপিপূর্ণ' বলে গণ্য করা হয়। আজ সেই দলের হাজারো নেতা-কর্মীর মতো তিনিও পড়েছেন নির্বাসনের জীবন।

কোন অভিযোগে জড়ালেন সাকিব?

বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন সাকিব, তাঁর মা শিরিন আখতার এবং আরও ১৩ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে। অভিযোগ শেয়ারবাজার কারসাজি, অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াতি এবং মানি লন্ডারিং-এর। এছাড়াও রয়েছে চেক জালিয়াতির অভিযোগ। মজার ব্যাপার হলো, এই অভিযোগগুলোর কিছু শেখ হাসিনার শাসনামলেই উঠেছিল, কিন্তু তখন কোনও তদন্ত হয়নি। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে যে, সাকিবের পিতা এক ছাত্রনেতা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। সবমিলিয়ে সাকিব ও তাঁর পরিবার এখন গভীর সংকটে।

ক্রিকেট থেকে রাজনীতি: এক রঙিন ক্যারিয়ার

সাকিবের জীবনের গল্পটা হলো ক্রিকেট, রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয় সহিংসতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ। ১৯৮৭ সালে মাগুরার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এই খেলোয়াড় ২০০৬ সালে জাতীয় দলে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রায় দুই দশকের ক্যারিয়ারে তিনি ৪৪৭ ম্যাচে করেছেন ১৪,৭৩০ রান এবং নিয়েছেন ৭১২টি উইকেট। ইএসপিএন ক্রিকইনফো তাকে ডাকে 'বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটার'।

কিন্তু বিতর্কও ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এবং আইসিসির শাস্তি তিনি বহুবার সহ্য করেছেন – একবার গ্রাউন্ডসম্যানকে হুমকি দেয়ার জন্য, আরেকবার টেলিভিশনে 'অশোভন অঙ্গভঙ্গি' করার জন্য। ২০১৯ সালে আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিট তাঁকে দুই বছরের (এক বছর স্থগিত) নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই সময়েই তিনি তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার করতে থাকেন।

রাজনীতিতে যোগ: যে সিদ্ধান্ত সব বদলে দিল

যে মুহূর্তে সাকিব আওয়ামী লীগে যোগ দেন, তখন দলটি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে ভোট কারচুপি, দুর্নীতি, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হাজার হাজার বিরোধী কর্মীকে কারাগারে পাঠানোর জন্য সমালোচিত। দেশের মানুষ জানে ক্ষমতায় টিকে থাকতে শেখ হাসিনা কতটা কঠোর পন্থা বেছে নিয়েছেন। তবুও সাকিব সেই দলেই যোগ দেন, যে দল বহু বাংলাদেশির কাছে দমন-পীড়নের প্রতীক।

জাতিসংঘ পর্যন্ত বলেছে, শেখ হাসিনার সরকার ২০২৪ সালের গণবিক্ষোভে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করতে পারে। ক্ষমতায় থাকাকালীন সাকিব নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসিনার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতার ছবি পোস্ট করতেন। ক্ষমতাচ্যুতির পরও সেই অভ্যাস তিনি বজায় রাখেন, যা তাঁর জন্য ডেকে আনে ভয়াবহ বিপর্যয়।

শেষ চাপাটি কী ছিল?

বর্তমানে সাকিব পরিবার নিয়ে আমেরিকায় বসবাস করছেন। সম্প্রতি, শেখ হাসিনার জন্মদিনে তিনি একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, 'শুভ জন্মদিন, আপা।'

এই একটি পোস্টই যেন শেষ চাপাটি হয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া সাংবাদিকদের জানান, সাকিব আল হাসান আর কখনো বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পারবেন না।

একজন সত্যিকারের প্রতিভাবান ক্রিকেটার শেষ পর্যন্ত একজন স্বৈরশাসকের সাথে তাঁর রাজনৈতিক আঁতাতের কারণেই তাঁর ক্যারিয়ার হারালেন। অসংখ্য বাংলাদেশির জন্য হাসিনা হলেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নিপীড়নের প্রতীক, যাঁর কারণে তাদের জীবন ও পরিবার ধ্বংস হয়েছে। সাকিব তাঁর রাজনৈতিক অন্ধ আনুগত্য এবং বাস্তবতা বোঝার অক্ষমতার কারণেই নিজের হাতে নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের কবর খুঁড়েছেন।

 

news